ঢাকা,রোববার, ২২ ডিসেম্বর ২০২৪

কক্সবাজার সিভিল সার্জন অফিসে দুর্নীতিবাজ শিক্ষা স্বাস্থ্য কর্মকর্তা উচাপ্রু বেপরোয়া

ািাাএম.শাহজাহান চৌধুরী শাহীন, কক্সবাজার ॥

কক্সবাজার সিভিল সার্জন অফিসে দীর্ঘ ১২ বছর ধরে অত্যন্ত দাপটের সাথে থাকা দুর্নীতিবাজ স্বাস্থ্য শিক্ষা কর্মকর্তা উচাপ্রু মারমার বিরুদ্ধে বিভাগীয় তদন্ত পূর্বক ব্যবস্থা নেয়ার জোর দাবি তুলেছেন জেলার ৫ লক্ষাধিক জনসাধারণ। ২ কোটি টাকার টেন্ডার জালিয়াতির ঘটনায় অভিযুক্ত সিভিল সার্জন ডাঃ কমরুদ্দীনকে ওএসডি করা হলেও তার সহযোগী উচাপ্রু এখনো বহাল তবিয়তে রয়েছে একই অফিসে।

জেলার ৫ লাখ মানুষের মৌলিক ও সেবামূলক প্রতিষ্ঠান সিভিল সার্জন অফিসের ওই কর্মকর্তার বিরুদ্ধে সেবার পরিবর্তে সীমাহীন দুর্নীতি ও অনিয়মের তথ্য নির্ভর সংবাদ দৈনিক আমাদের কক্সবাজার পত্রিকায় প্রকাশের পর পুরো জেলায় চাঞ্চল্যের সৃষ্টি হয়। তথ্যভিত্তি সংবাদ প্রকাশ হওয়ায় বিভিন্ন ব্যক্তি ও প্রতিষ্টান পত্রিকাকে সাধুবাদ জানালেও আরো বেপরোয়া হয়ে উঠেছে উচাপ্রু। তার সিন্ডিকেটের লোকজন চরম ভাবে ক্ষেপে গিয়ে সাংবাদিক ও পত্রিকা অফিসে হামলার প্রকাশ্যে হুমকিসহ তার কাছ থেকে মিডিয়া নিয়ন্ত্রনের নামে প্রতিমাসে মোটা অংকের অনৈতিক সুবিধা নেয়া মহল বিশেষ বিভিন্ন ষড়যন্ত্রের জাল বুনছে বলে অভিযোগ পাওয়া গেছে।

অভিযোগ পাওয়া গেছে, কক্সবাজার সিভিল সার্জন অফিসে দীর্ঘ একযুগ ধরে কর্মরত সিনিয়র স্বাস্থ্য শিক্ষা কর্মকর্তা উচাপ্রু মারমার নেতৃত্বে সিন্ডিকেট ভ্রাম্যমান আদালতের হুমকি ও মানব স্বাস্থ্য নিয়ে ছিনিমিনি খেলায় জড়িতদের কাছ থেকে মাসোহারা তুলেই মাসে নগদ অর্ধকোটিরও বেশি টাকা উৎকোচ বাণিজ্যে জড়িত রয়েছে। এই উচাপ্রুর প্রত্যক্ষ ইন্দনে চক্রের অধীনে জেলার আট উপজেলায় রয়েছে উপজেলা ভিত্তিক আরো বেশকিছু চাঁদা উত্তোলনকারী দালাল চক্র। যারা প্রতিনিয়তই কক্সবাজার জেলার উপজেলাগুলোর আনাচে-কানাচে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা প্রায় সহস্রাধিক পল্লী চিকিৎসক, অননুমোদিত ঔষুধের দোকান, ইউনানী, হারবাল, আর্য়ুবেদীয়, লতা-পাতার ঔষুধ বিক্রেতা এমনকি ঝাঁড়ফোঁক (বৈদ্য) চক্রের কাছ থেকে দৈনিক-মাসিক ও সাপ্তাহিক চুক্তিতে এসব টাকা তুলে ভাগ-বাটোয়ারায় লিপ্ত রয়েছে। বছরের পর বছর ধরে সিভিল সার্জন অফিসে নিজেদের সরকারী দায়িত্বের অন্তরালে এই অপকর্মে লিপ্ত রয়েছে। এসব অপকর্ম ঢাকা দিতে মিডিয়া নিয়ন্ত্রণের নামে কিছু সংবাদকর্মী নামধারী ব্যক্তি লাখ টাকা অনৈতিক সুবিধা নিয়ে থাকলেও বিষয়টি বরাবরই অদৃশ্য থেকে যাচ্ছে।

আরো জানা যায়, সিভিল সার্জন অফিসের উক্ত দুষ্ট চক্র শুধু চাঁদাবাজিতে জড়িত নয়, তাদের ঘুষ বাণিজ্য আরো বিভিন্ন ভাবে বিস্তৃত। পিলে চমকানো তথ্য হচ্ছে, স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের অধীনস্থ উক্ত সিভিল সার্জন অফিসের দুর্নীতিবাজরা মন্ত্রণালয়ের দায়িত্বরত নিজেদের উর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষ, জেলা প্রশাসনের অধিনস্থ ভ্রাম্যমান আদালতের ম্যাজিষ্ট্রেট ও পুলিশ বাহিনীর নাম ভাঙ্গিয়েও মাসের শেষে ঘুষের টাকা বেশি পেতে জেলা শহর সহ বিভিন্ন স্থানে অবস্থিত প্রাইভেট হাসপাতাল, ক্লিনিক, প্যাথলজি ও ভূঁইফোড় ঔষুধ কর্তৃপক্ষের কাছ থেকেও গাণিতিক হারে চাঁদাবাজিতে লিপ্ত রয়েছে।

সিভিল সার্জন অফিস সূত্রে জানা গেছে, ২০১৫-১৬ অর্থ বছরে জেলার সকল স্বাস্থ্য প্রতিষ্ঠানে ঔষধ, সার্জিক্যাল প্রয়োজনীয় যন্ত্রপাতি, হাসপাতালের প্রয়োজনীয় কিছু সরঞ্জাম সরবরাহ করার জন্য গোপনে ২ কোটি টাকার একটি দরপত্র গ্রহন এবং যাচাই বাছাই প্রক্রিয়া শেষ করে। দরপত্র মূল্যায়ন কমিটির বেশির ভাগ সদস্যের অনুপস্থিতে শুধুমাত্র সিভিল সার্জনের গোপন যোগসাজসে এবং স্বাস্থ্য শিক্ষা কর্মকর্তা উচাপ্রুর মধ্যস্থতায় নোয়াখালীর একটি ঠিকাদারী প্রতিষ্ঠানকে কাজ পাইয়ে দেন। এতে স্থানিয় ঠিকাদারী প্রতিষ্ঠানগুলো চরম হতাশা এবং ক্ষুব্দ হয়ে উঠে।

গত ১৭ জানুয়ারি দরপত্র জমা দেওয়ার শেষ দিন ঢাকা এবং নোয়ালখালীর কয়েকটি ফার্মের মালিক ঠিকাদার হাসান মনসুর শাহিন দরপত্র জমা দিলে বিষয়টি প্রকাশ পায়। এরপর এঘটনা গত ১৯ জানুয়ারি একটি জাতীয় দৈনিকে ও কক্সবাজারের কয়েকটি স্থানীয় দৈনিকে প্রকাশিত হলে সাধারণ ঠিকাদারদের তোপের মুখে পড়ে দরপত্র বাতিল করতে বাধ্য হন সাবেক সিভিল সার্জন কমরুদ্দীন। সর্বশেষ অদ্ভুত শর্তজুড়ে দিয়ে আগামি ২২ ফেব্রুয়ারি সোমবার দরপত্র জমা দেওয়ার ও খোলার দিন নির্ধারণ করে আবারও দরপত্র আহ্বান করা হয়। যা বাতিল করার জন্য ২০ ফেব্রুয়ারী কয়েকজন ঠিকাদার কক্সবাজারের সিভিল সার্জনকে আইনগত নোটিশ দেন। একই ভাবে সিভিল সার্জনের বিরুদ্ধে চরম অনিয়ম দুর্নীতির ব্যাপারে জেলা প্রশাসককে লিখিত অভিযোগ করেন বেশ কয়েকজন ঠিকাদারী প্রতিষ্ঠান।

একটি সুত্র জানায়, মূলত সিভিল সার্জন কমরুদ্দীন যোগদানের পর থেকে অফিসের দুর্নীতির পরিমান আরো বেড়ে যায়। তার অন্যতম সহযোগী হিসেবে সিনিয়র স্বাস্থ্য শিক্ষা কর্মকর্তা উচাপ্রু মারমা বলে দাবী করেন একই অফিসের বেশ কিছু পদস্থ কর্মকর্তা। এনিয়ে বেশকয়েকটি অভিযোগ ঢাকা স্বাস্থ্য অধিদপ্তরে গেলে তারা তদন্ত করে তার সত্যতা পাওয়ায় সিভিল সার্জন কমরুদ্দীনকে ঢাকা তে ওএসডি করা হয়। ২৪ ফেব্রুয়ারী এ সংক্রান্ত কাগজ সিভিল সার্জন অফিসে এসে পৌঁছে। পরিপত্রে বলা হয় কক্সবাজার সিভিল সার্জন ডাঃ কমর উদ্দিনকে পূর্ণ আদেশ না দেওয়া পর্যন্ত স্বাস্থ্য অধিদপ্তরে বিশেষ ভারপ্রাপ্ত কমকর্তা করা হয়েছে। এতে স্বাক্ষর করেছে স্বাস্থ্য ও পরিবার পরিকল্পনা মন্ত্রণালয়ের উপ সচিব (পার-২) একে এম ফজলুল হক।

ঘোর অভিযোগ পাওয়া গেছে, মেডিকেল পণ্য (এমএসআর) সামগ্রী সরবরাহের টেন্ডার নিয়ে প্রতিবছরই বড় ধরনের জালিয়াতির ঘটনা ঘটে আসছিল। সরকারিভাবে বরাদ্দকৃত জেলার পাঁচ লক্ষাধিক মানুষের জীবন রক্ষাকারী মূল্যবান ওষুধ সামগ্রীর প্রায় সিংহভাগ কালো বাজারে বিক্রি করে দেওয়ার অভিযোগ পাওয়া গেছে। সরকারের স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় থেকে মাসিক, ত্রৈমাসিক, বাৎসরিক কোটি কোটি টাকা মূল্যের ওষুধ বরাদ্দ দিলেও জেলা সদর হাসপাতালসহ জেলার ৮টি উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্স ও হাসপাতালে সরেজমিনে ঘুরে দেখা গেছে, শত শত আসা রোগীদের প্যারাসিটামল ও হিসটাসিন ছাড়া এমনকি কোন কোন সময় শুধু ব্যবস্থাপত্র ছাড়া কোন প্রকার ওষুধ দেয়া হচ্ছে না। অভিযোগ রয়েছে এধরনের ঘটনায়ও জড়িত রয়েছে সেই উচাপ্রু।

এব্যাপারে উখিয়া, রামু ও টেকনাফ স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে কর্তব্যরত বেশ কয়েকজন ডাক্তার নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক সাংবাদিকদের জানান, সিভিল সার্জন অফিস থেকে যদি ওষুধ বরাদ্দ না দেয় তাহলে আমরা কিভাবে রোগীদের চাহিদামত ওষুধ দেব? সিভিল সার্জন অফিসে অনিয়মের কারণে আটটি উপজেলার স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে গুলোর অবস্থা খুব নাজুক।

নাম প্রকাশ না করার শর্তে সিভিল সার্জন অফিসের একজন কর্মকর্তা জানান, দুর্নীতিবাজ উচাপ্রুর হর্তাকর্তা হচ্ছে চট্টগ্রাম বিভাগীয় স্বাস্থ্য পরিচালক ডাঃ আলা উদ্দিন। এই ডাঃ আলা উদ্দিনকেই প্রতি মাসে লাখ লাখ টাকা দিয়ে কক্সবাজার সিভিল সার্জন অফিসেই দীর্ঘ ১২ বছর বহাল রয়েছেন। ইতোপূর্বে তার বদলির অর্ডার হয়েছিল ৭ বার। কিন্তু বরাবরই ঘুষের লেনদেন করেই এখানেই পুনঃবহাল রয়েছে। সরকারী চাকুরী বিধি অনুযায়ী ৩ বছরের অধিক একই স্থানে থাকার কোন বিধান নেই বলেও জানান এই কর্মকর্তা।

উপরোক্ত অভিযোগগুলো অস্বীকার করে অভিযুক্ত সিনিয়র স্বাস্থ্য শিক্ষা কর্মকর্তা উচাপ্রু মারমা দাবী করেন সরকার প্রয়োজন মনে করছে বিধায় আমাকে এখানে রেখেছেন ।

এদিকে, গত ১৬ মার্চ দৈনিক আমাদের কক্সবাজার সহ বিভিন্ন অনলাইনে প্রতিমাসে অর্ধ কোটি টাকার উৎকোচ বাণিজ্য,সিভিল সার্জন অফিসে দীর্ঘ ১২ বছর বহাল স্বাস্থ্য শিক্ষা কর্মকর্তা উচাপ্রু’ শিরোনামে একটি তথ্যসমৃদ্ধ সংবাদ প্রকাশ হলে পুরো জেলায় তোলপাড় সৃষ্টি হয়। বিভিন্ন ব্যক্তি ও প্রতিষ্টান এই পত্রিকাকে সাধুবাদ জানান। কিন্তু আতে ঘা লেগেছে একটি চাঁদাবাজ মহলের। যারা এই সিভিল সার্জন অফিস থেকে প্রতিমাসে মিডিয়া নিয়ন্ত্রণের নামে মোটা অংকের অর্থ আদায় করেন সেই মহলের। তার সিন্ডিকেটের লোকজন চরম ভাবে ক্ষেপে গিয়ে সাংবাদিক ও পত্রিকা অফিসে হামলার প্রকাশ্যে হুমকিসহ তার কাছ থেকে মিডিয়া নিয়ন্ত্রনের নামে প্রতিমাসে অনৈতিক সুবিধা নেয়া মহল বিশেষ বিভিন্ন ষড়যন্ত্রের জাল বুনছে বলে অভিযোগ পাওয়া গেছে। এঘটনায় জড়িত রয়েছে জেলার অখ্যাত একটি পত্রিকার সম্পাদক নামধারী ব্যক্তিও।

কক্সবাজার সিভিল সার্জন ( ভারপ্রাপ্ত) ডাঃ আলমগীর এর সাথে যোগাযোগ করা হলে তিনি বলেন, সিনিয়র স্বাস্থ্য শিক্ষা কর্মকর্তা উচাপ্রু মারমার বিরুদ্ধে বিভিন্ন অভিযোগ শুনে আসছি। আমি এক সপ্তাহ হলো সিভিল সার্জন ( ভারপ্র্প্তা) দায়িত্ব নিয়েছে। তার কর্মকান্ড নিয়ে আমিও বিব্রতকর অবস্থায় পড়ে যাচ্ছি। উচাপ্রু মারমা কিভাবে দীর্ঘ ১২ বছর একই স্থানে কর্মরত আছেন সেটা উধর্বতন কর্তৃপক্ষ জানেন।

পাঠকের মতামত: